নীল সবুজের দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি এই বাংলাদেশের রূপে মুগ্ধ হয়ে পুলকিত কবি তার আবেগ স্নিগ্ধ উচ্চারণে বাংলাকে বলেছেন রূপসী বাংলা। ছয় ঋতুর এই রূপসী বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশ।বাংলাদেশের জলবায়ু সমভাবাপন্ন। বাংলাদেশের রয়েছে অফুরন্ত প্রাকৃতিক শোভা। এদেশের পাহাড়-পর্বত, বর্ণাঢ্য উপজাতি, সবুজ বন-বনাদি, বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন, কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত, নদ-নদী, চা বাগান, প্রাচীন ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ভ্রমণপিপাসু উৎসাহী মানুষকে আকৃষ্ট করে আসছে। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের দেশটি যেন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক মিউজিয়াম। তাই প্রাচীনকাল থেকে বহু জ্ঞানী-গুণী বিদেশি পর্যটক বাংলার বুকে পা রেখে রূপসী এদেশ দেখে মুগ্ধ হয়েছেন। তাইতো কবি বলেন-
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি
প্রাচীনকাল থেকেই অতিথিপরায়ণতা, সমৃদ্ধি ও সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করে এসেছে বাংলাদেশ। এত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও অন্যান্য দেশের মতো পর্যটন বাংলাদেশে এখনো শিল্প হিসেবে পূর্ণ বিকশিত হতে পারেনি। অথচ দারিদ্র বিমোচনে এবং দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে পর্যটনশিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। পর্যটকদের আকৃষ্ট করার মতো এখানে অনেক উপকরণ থাকলেও স্বাধীনতার পূর্বে এ ব্যাপারে কার্যত কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়নি।স্বাধীনতার পর পর্যটনের ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয় এবং এর সম্প্রসারণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশন নামে একটি জাতীয় পর্যটন সংস্থা গঠিত হয়।দেশের পর্যটন ও উন্নয়নের স্বার্থে প্রয়োজনীয় সকল প্রকার কার্য পরিচালনার একক দায়িত্ব এ সংস্থার উপর ন্যস্ত হয় এবং সংস্থাটি নতুন নতুন প্রকল্প গ্রহণ ও সেগুলো বাস্তবায়নের কাজ শুরু করে। বিদেশি পর্যটকদের আকর্ষণের জন্য সৌন্দর্য ও সংস্কৃতি তুলে ধরে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বৃদ্ধির কাজও করে থাকে পর্যটন কর্পোরেশন।
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে দু চোখ জুড়িয়ে যায়। প্রকৃতির অঢেল সৌন্দর্য ছড়িয়ে আছে গোটা দেশজুড়ে; তবে অঞ্চলভেদে বৈচিত্রও আছে ।
নদীমাতৃক এই বাংলাদেশের অন্যতম একটি জেলা ফরিদপুর। ২০৭২.৭২ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই জেলাটির উত্তর-পূর্বাংশ পদ্মা নদী দ্বারা আবদ্ধ।
ফরিদপুর জেলার নামকরণ করা হয়েছে এখানকার প্রখ্যাত সুফি সাধক শাহ্ শেখ ফরিদ উদ্দিন এর নামানুসারে। এই জেলার পূর্বনাম ছিল ফতেহাবাদ। ১৭৮৬ সালে জেলাটির প্রতিষ্ঠাকালে এর নাম ছিল জালালপুর এবং এর প্রধান কার্যালয় ছিল ঢাকা। ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে এটি ঢাকা হতে বিভক্ত হয়ে ফরিদপুর জেলা নামে অভিহিত হয় এবং এর প্রধান কার্যালয় স্থাপন করা হয় ফরিদপুর শহরে । গোয়ালন্দ, ফরিদপুর সদর, মাদারীপুর ও গোপালগঞ্জ এই চারটি সমন্বয়ে ফরিদপুর জেলা পূর্ণাঙ্গতা পায়। বর্তমানে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলা ফরিদপুর, রাজবাড়ী, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর ও শরীয়তপুর এই ৫টি জেলায় রূপান্তরিত হয়েছে।
ফরিদপুর জেলায় রয়েছে বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান। যার মধ্যে রয়েছে নদী গবেষণা ইন্সটিটিউট, দিঘীরপাড় গাইবি মসজিদ, গেরদা, রাজেন্দ্র কলেজ, পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের বাসভবন, আটরশি বিশ্ব জাকের মঞ্জিল, পদ্মাবাঁধ, পদ্মা নদীর বালুচর, শেখ রাসেল শিশু পার্ক, শেখ জামাল স্টেডিয়াম, মীরগঞ্জ নীলকুঠি (আলফাডাঙ্গা)। এলাকার উল্লেখযোগ্য স্থাপনা গুলোর মধ্যে রয়েছে ফতেহাবাদ টাক্শাল, মথুরাপুর দেওল, বসুদেব মন্দির ও জগবন্ধু আঙিনা। এছাড়াও এই জেলায় রয়েছে বেশকিছু প্রত্নসম্পদ। শের শাহ্ গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড, মথুরাপুর দেওল, পাথরাইল মসজিদ ও দিঘি, সাতর শাহী মসজিদ, ফরিদপুর জেলা জজ্ কোর্ট ভবন, ভাঙ্গা মোফেন্স আদালত ভবন এবং কানাইপুর জমিদারবাড়ি অন্যতম। পদ্মা নদী দ্বারা আবদ্ধ হওয়ায় ফরিদপুর জেলা টি পাট বাণিজ্য ও বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশ ব্যবসায়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। এছাড়াও এই জেলার খেঁজুরের গুড় খুবই বিখ্যাত এবং রপ্তানিযোগ্য। ফরিদপুর ঐতিহ্যবাহী বাউল, মারামি, বিচার, মুর্শিদী-মারফতি, ফকিরালি, গাজীর গান, কবি গান, জারি গান সংগীত সহ বিভিন্ন লোকসঙ্গীতে সমৃদ্ধ। তবে এর মধ্যে অনেকগুলোই এখন বিলুপ্তপ্রায়।
এ জেলায় জন্মগ্রহণ করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (বাংলাদেশের জাতির জনক), মুন্সি আব্দুর রউফ (বীরশ্রেষ্ঠ), নবাব আব্দুল লতিফ (সমাজ সংস্কারক), মহাকবি আলাউল (মধ্যযুগের কবি), সুকান্ত ভট্টাচার্য (ক্ষনজন্মা প্রতিভাবান বাঙালী কবি), পল্লী-কবি জসিম-উদ্দিন, রবীন্দ্রনাথ মৈত্র (বাঙালি সাহিত্যিক) কাজী মোতাহার হোসেন (বিখ্যাত লেখক, বিজ্ঞানী, দাবাড়ু, সাবেক জাতীয় অধ্যাপক), শরৎ চন্দ্র রায় চৌধুরী (স্বাধীনতা সংগ্রামী ও ফরিদপুর জেলা কংগ্রেস সভাপতি),সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় (ঔপন্যাসিক, কবি), নরেন্দ্রনাথ মিত্র(ঔপন্যাসিক), হুমায়ুন কবির(শিক্ষাবিদ), মৃণাল সেন(ভারতীয় বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক, চিত্রনাট্যকার ও লেখক), তারেক মাসুদ(চলচ্চিত্রকার), সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী(সংসদ সদস্য, সংসদ উপনেতা, সাবেক বন ও পরিবেশমন্ত্রী), রমেশচন্দ্র মজুমদার (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, বিখ্যাত লেখক, গবেষক) এবং আরো অনেক স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব; যারা এই জেলার সুনাম বহুগুণ বৃদ্ধি করেছেন। পরিবহনের দিক থেকে ফরিদপুর পশ্চিমবঙ্গের ভারতীয় রেলপথের সাথে ট্র্যাক যুক্ত বাংলাদেশ রেলপথের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। এটি কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, খুলনা, বরিশাল ও যশোরের সড়কের সাথে যুক্ত।
রাজবাড়ী জেলা বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলের ঢাকা বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল এবং অন্যতম চরাঞ্চল ও বটে । রাজবাড়ী যে কোন রাজার বাড়ীর নামানুসারে নামকরণ করা হয়েছে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। রাজা সূর্য কুমারের নামানুসারে রাজবাড়ির নামকরণ করা হয়। এটি বৃহত্তর ফরিদপুরের একটি অংশ। এর আয়তন ১১১৮.৮ বর্গকিলোমিটার। একসময় রাজবাড়ী অঞ্চল যশোর জেলার অন্তর্গত ছিল। ফরিদপুর জেলা গঠিত হলে ১৮১১ সালে রাজবাড়ী এর অন্তর্ভুক্ত হয়।
এখানকার দর্শনীয় স্থান গুলোর মধ্যে রয়েছে মীর মশাররফ হোসেনের মাজার, মুকুন্দিয়া জমিদার বাড়ি, বহরপুর বিনোদন কেন্দ্র, গোয়ালন্দ ফেরি, শাহ্ পালোয়ানের মাজার, মনো-মিয়ার মাজার, দাদসী মাজার শরীফ, জুর বাঙালি মন্দির, নীল কুঠি, চাঁদ সওদাগরের ঢিবি, মীর মোশাররফ হোসেন স্মৃতিসৌধ কেন্দ্র, রাজবাড়ি সরকারি কলেজ, দৌলতদিয়া ঘাট,কল্যাণ দিঘি, রথখোলা সানমঞ্চ, গোয়ালন্দঘাট,উল্লেখযোগ্য। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি চিহ্নের মধ্যে রয়েছে চারটি গণকবর।
রাজবাড়ি জেলার অর্থনীতি কৃষিনির্ভর। ধান, পাট, গম, পেঁয়াজ, রসুন, হলুদ, বাদাম, তিল, যব, ভুট্টা, ইক্ষু, ডাল, তেলের বীজ, আম, কাঁঠাল, নারকেল, খেজুর, লিচু ইত্যাদি এখানকার প্রধান কৃষি পণ্য।
এছাড়া কলা এবং মাছ চাষ করা হয়। তাছাড়া রাজবাড়ী জেলা চমচমের জন্য বিশেষ ভাবে পরিচিত। জেলাটি শিল্পে সমৃদ্ধ না হলেও অর্থনীতিতে অবদান রয়েছে
এ জেলায় জন্মগ্রহণ করেছেন মীর মশাররফ হোসেন (ঔপন্যাসিক, নাট্যকার ও প্রাবন্ধিক), ডঃ কাজী মোতাহার হোসেন (বাংলাদেশী পরিসংখ্যানবিদ, বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ), মোঃ এয়াকুব আলী চৌধুরী , কাজী আবদুল ওয়াদুদ, মনসুর উল করিম (একুশে পদক প্রাপ্ত চিত্রশিল্পী, শিক্ষক), সোহেলী আক্তার (বাংলাদেশী মহিলা ক্রিকেটার), খবিরুজ্জামান (বীর বিক্রম) ।
খাগড়াছড়ি জেলা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত চট্টগ্রাম বিভাগের একটি প্রশাসনিক অঞ্চল। এটি একটি পার্বত্য জেলা। উপজেলার সংখ্যানুসারে খাগড়াছড়ি বাংলাদেশের একটি এ শ্রেণীভুক্ত জেলা।
খাগড়াছড়ি একটি নদীর নাম। নদীর পাড়ে খাগড়া বন থাকায় পরবর্তী কালে তা পরিষ্কার করে জনবসতি গড়ে উঠে, ফলে তখন থেকেই এটি খাগড়াছড়ি নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৮৬০ সালের ২০ জুন রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান- এই তিন পার্বত্য অঞ্চলকে নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা সৃষ্টি হয়। জেলা সৃষ্টির পূর্বে এর নাম ছিল কার্পাস মহল। পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা থেকে ১৯৮১ সালে বান্দরবান এবং ১৯৮৩ সালে খাগড়াছড়ি পৃথক জেলা সৃষ্টি করা হয়।জেলার উত্তর ও পশ্চিমে ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য, দক্ষিণে চট্টগ্রাম ও রাঙ্গামাটি জেলা এবং পূর্বে রাঙ্গামাটি জেলা অবস্থিত। জেলাটির মোট আয়তন ২৬৯৯.৫৫ বর্গ কিলোমিটার এবং এর ৯টি উপজেলা হল - খাগড়াছড়ি সদর, দীঘিনালা, পানছড়ি, মাটিরাঙ্গা, গুইমারা, মানিকছড়ি, মহালছড়ি, লক্ষ্মীছড়ি ও রামগড়।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ১৩ টি উপজাতির জীবন যাত্রা স্বতন্ত্র, বৈচিত্রময় কিন্তু সহজ সরল। এই নৃগোষ্ঠীসমূহের মধ্যে চাকমা, ত্রিপুরা ও মারমা পর্যায়ক্রমিক সংখ্যাগরিষ্ঠ।পাহাড়, ছোট ছোট নদী, ছড়া ও সমতল ভূমি মিলে এটি একটি অপরূপ সৌন্দর্য্যমন্ডিত ঢেউ খেলানো এলাকা। চেঙ্গী, মাইনী ও ফেণী প্রভৃতি এ জেলার উল্লেখযোগ্য নদী।
এখানকার দর্শনীয় স্থান ও পর্যটন কেন্দ্র গুলোর মধ্যে রয়েছে- আলুটিলা পর্যটন কেন্দ্র, আলুটিলার ঝর্ণা বা রিছাং ঝর্ণা, আলুটিলার সুড়ঙ্গ বা আলুটিলা পাহাড়ের রহস্যময় সুড়ঙ্গ, রিছাং ঝর্ণা, নূনছড়ি দেবতা পুকুর (দেবতার লেক), ভগবান টিলা , দীঘিনালা সংরক্ষিত বনাঞ্চল, শান্তিপুর অরণ্য কুটির, বিডিআর স্মৃতিসৌধ, মায়াবিনী লেক, রামগড় লেক, দুই টিলা ও তিন টিলা, দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি পাহাড়ি কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, জেলা পরিষদ পার্ক, ডিসি পার্ক । এছাড়া ও রয়েছে রামগড় চা-বাগান।
খাগড়াছড়ি জেলার প্রধান কৃষিজ ফসল হল - ধান ,গম, ভুট্টা, সরিষা, তুলা, আখ ও শাকসবজি ইত্যাদি এবং ফলমূলের মধ্যে আছে- আম, কাঁঠাল, আনারস, কলা, পেঁপে, পেয়ারা, লেবু ও তরমুজ ইত্যাদি।এখানকার প্রাকৃতিক খনিজ সম্পদ হল গ্যাস (সিমুতাং গ্যাসফিল্ড, মানিকছড়ি)। বনজ সম্পদের মধ্যে রয়েছে- সেগুন, গামারী, কড়ই, গর্জন, চাপালিশ, জারুল ইত্যাদি।
খাগড়াছড়ি জেলার কৃতী ব্যক্তিত্বের মধ্যে রয়েছেন- অনন্ত বিহারী খীসা (শিক্ষাবিদ ও উপজাতি নেতা), আনাই মগিনি (নারী ফুটবলার), আনুচিং মগিনি (নারী ফুটবলার), এ কে এম আলীম উল্লাহ (রাজনীতিবিদ), ওয়াদুদ ভূইয়া (রাজনীতিবিদ), কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা (রাজনীতিবিদ), প্রভাংশু ত্রিপুরা (লেখক ও গবেষক), মনিকা চাকমা (নারী ফুটবলার), মং প্রু সাইন (মং রাজবংশের সপ্তম রাজা ও বীর মুক্তিযোদ্ধা), যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা (রাজনীতিবিদ), সমীরণ দেওয়ান (রাজনীতিবিদ), নির্মলেন্দু চৌধুরী (রাজনীতিবিদ)।