সতের শতকের শেষ দিকে পূর্ববঙ্গের সবচেয়ে বড় ও পুরোনো জমিদারি ভাওয়াল এস্টেটের জন্ম। এ জমিদার পরিবার ১৮৭৮ সালে ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে রায় ও রাজা খেতাব লাভ করে। এ জমিদারির কেন্দ্র ছিল জয়দেবপুর। জমিদারির উত্তরাধীকারী রমেন্দ্র নারায়ণ রায় ১৯০৯ সালের এপ্রিলে স্ত্রী বিভাবতী দেবী, শ্যালক সত্যেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং একদল কর্মচারী – ভৃত্যসহ চিকিৎসার জন্য দার্জিলিং যান। এক পর্যায়ে ভাওয়াল এস্টেটে খবর যায় যে অসুস্থ রমেন্দ্র নারায়ণ দার্জিলিংয়ে মারা গেছেন এবং সেখানেই তাঁকে দাহ করা হয়েছে। রমেন্দ্র নারায়ণের স্ত্রী, শ্যালক ও অন্যরা দেশে ফিরে আসেন।
এর প্রায় এগার বছর পরে ১৯২০ সালে রমেন্দ্র নারায়ণ সন্ন্যাসীবেশে ঢাকায় আবির্ভূত হন! অনেকে তাঁকে চিনতে পারলেও প্রথমে রাজা নিজ পরিচয় গোপন রাখেন। কিন্তু যারা চিনে ফেলেছিলেন তারা ১৯২২ সালে সন্ন্যাসরূপী রাজাকে ভাওয়ালে নিয়ে যান। রাজা তাঁর আসল পরিচয় ঘোষণা করেন। কিন্তু রাজ পরিবার তাঁকে রমেন্দ্র নারায়ণ বলে মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানায়। তারা দাবি করেন রমেন্দ্র নারায়ণ ১৯০৯ সালেই দার্জিলিংয়ে মারা গেছেন এবং সেখানে তাঁকে দাহ করা হয়েছে।
সন্ন্যাসীবেশী রমেন্দ্র তাঁর উত্তরাধিকারের দাবিতে অটল থাকেন। কিন্তু নিজের স্ত্রী পর্যন্ত তাঁর পরিচয় মেনে নিতে অস্বীকৃতি জানান। এ নিয়ে শেষ পর্যন্ত মামলা হয়। ১৯৩৫ সালে রমেন্দ্র নারায়ণ ঢাকা জজকোর্টে উত্তরাধিকার মামলাটি করেন। আদালতে রমেন্দ্র দাবি করেন তিনি শ্যালক সত্যেন্দ্রনাথ ও পারিবারিক চিকিৎসক আশুতোষ দাসগুপ্তের ষড়যন্ত্রের শিকার।
রমেন্দ্র নারায়ণ দাবি করেন তাঁকে সিফিলিসের চিকিৎসার জন্য ষড়যন্ত্র করে দার্জিলিং নিয়ে যাওয়া হয়। শ্যালক ও অন্যরা বিষপ্রয়োগ করে মেরে তাঁকে রাতের অন্ধকারে দ্রুত দাহ করার পরিকল্পনা করেন। বিষ খাওয়ানোর অল্প সময় পরই রমেন্দ্র মৃত ভেবে দাহ করতে শ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু হঠাৎ শিলাঝড় শুরু হলে ভাড়া করা ডোমরা রমেন্দ্রকে ফেলে চলে যায়। বৃষ্টির ধারায় রমেন্দ্রর কিছুটা চেতনা ফিরে আসে।
এসময় একদল সন্ন্যাসী শ্মশানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁকে এ অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে তুলে নিয়ে সেবাশুশ্রূষা করেন। সন্ন্যাসীদের সেবায় রাজা বেঁচে উঠলেও বিষের প্রতিক্রিয়ায় তিনি স্মৃতিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন। এরপর ১৯০৯ থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত রমেন্দ্র ওই সন্ন্যাসীদের সঙ্গেই ঘুরে বেড়ান। ১৯২০ সালে সন্ন্যাসীদের সঙ্গে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এলে হঠাৎ তাঁর স্মৃতিশক্তি ফিরে আসে। এরপর রমেন্দ্র নারায়ণ সন্ন্যাসী জীবন শেষ করার পরিকল্পনা করেন এবং সদরঘাটের বাকল্যান্ড বাঁধের এক পাশে থাকতে শুরু করেন।
দীর্ঘ সময় ধরে সাক্ষ্যপ্রমাণ গ্রহণশেষে ১৯৩৭ সালের ২ ডিসেম্বর বিচারক রায় দেন যে সন্ন্যাসীই ভাওয়াল রাজ্যের সহঅংশীদার কুমার রমেন্দ্র নারায়ণ রায়। কিন্তু তাঁর স্ত্রী বিভাবতী এ রায় না মেনে উচ্চ আদালতে আপিল করেন। কলকাতা হাইকোর্ট জেলা জজের রায় বহাল রাখে। ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলা
তখনকার সংবাদপত্রে বেশ গুরুত্বের সঙ্গে স্থান পেয়েছিল। এ মামলা নিষ্পত্তি হওয়ার পরও নানা সময় গীত-গাথা, যাত্রাপালা, নাটক ও চলচ্চিত্রের উপজীব্য হয়েছিল ভাওয়াল রাজ্যের এই আলোড়ন তোলা কাহিনী।